জাতীয় নিউজ ২৪ | অনলাইন ডেস্ক
দেশব্যাপী একের পর এক সংঘটিত ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে গতকাল শনিবারও উত্তাল ছিল রাজধানী। শাহবাগ ছাড়াও সংসদ ভবন এলাকা, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পৃথক সমাবেশ হয়েছে। এসব সমাবেশ থেকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আইন করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।
সমাবেশগুলোতে বক্তারা বলেন, ধর্ষণ মামলার তদন্তে গাফিলতি ও বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ধর্ষণ রোধে আইনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ঘরে-বাইরে সংঘটিত ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না হওয়ায় এই পাশবিক ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ক্ষমতাবানদের প্রশ্রয়ের কারণে ধর্ষণকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের দায়ে প্রতিষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের গ্রেপ্তার দাবিতে গতকাল বিকেলে শাহবাগ চত্বর অবরোধ করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।
সংসদ ভবনের সামনে সমাবেশ : ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে মানিক মিয়া এভিনিউ। নারীবাদী সংগঠনগুলোর জোট ‘প্রজন্মান্তরে নারীবাদী মৈত্রী’র ডাকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যানার-ফেস্টুন ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এতে অংশ নেয়।
বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণাসহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। সমাবেশে নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরিণ হক দাবিগুলো তুলে ধরে বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড কোনো সমাধান নয়, ধর্ষণের সংস্কৃতি সমূলে উৎপাটন চাই।’
দাবিনামায় বলা হয়, ‘আমরা সব ধরনের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অবসান চাই, সেই সহিংসতা পুরুষতন্ত্র প্রভাবিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো সমর্থিত হোক বা যেকোনো পুরুষ বা পুরুষ দলের দ্বারা সংঘটিত হোক। সমাজের যেকোনো পরিসরে যৌন সহিংসতার ঘটনায় ভুক্তভোগীকে দায়ী করা চলবে না। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের যেকোনো সহিংসতার জন্য পরিবার তাদেরই জবাবদিহি করবে। ধর্ষক কোনোভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও পরিবারে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময়ে, যেকোনো প্রয়োজনে নারীরা চলবে নিরাপদে। সম্মান নারীর শরীরে—এমন ধারণার অবসান চাই।’
দাবি তুলে ধরে আরো বলা হয়, পাঠক্রমে যৌনশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সাইবার মাধ্যম ব্যবহার করে নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের বিষয়টি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে আইন সংস্কার করতে হবে। একই সঙ্গে ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট’ প্রস্তাবিত ১০ দফা দাবি অনতিবিলম্বে মেনে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থাৎ লিঙ্গ ও বয়স-নির্বিশেষে বিনা সম্মতিতে যেকোনো যৌনকর্মকে অপরাধ গণ্য করে ধর্ষণের সংজ্ঞা সংশোধন করতে হবে। ভুক্তভোগীকে দায়ী করার সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা বন্ধে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সংশোধন করতে হবে। লিঙ্গ, ধর্ম, গোষ্ঠী, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, প্রতিবন্ধকতা, যৌন-পরিচিতি যৌনতা-নির্বিশেষে সব ধরনের ভুক্তভোগী ও সহিংসতা জয়ীর জন্য সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের শিকারদের মামলা পরিচালনাকালে লিঙ্গভিত্তিক সংবেদনশীল আচরণ করতে পুলিশ, আইনজীবী, বিচারক ও সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক জোটের সমাবেশ : ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে গতকাল বিকেলে সমাবেশ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। একই সঙ্গে দেশের ৪৫টি জেলায় সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সমাবেশ থেকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টির জন্য প্রতি শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সাংবাদিক আবেদ খান, জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, নাট্যশিল্পী নাদের চৌধুরী, ত্রপা মজুমদার, চারুশিল্পী কামাল পাশা চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী শিরিন ইসলাম, সংস্কৃতিকর্মী সঙ্গীতা ইমাম, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এফ এম শাহীন প্রমুখ।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আজকের এই বাংলাদেশ আমরা চিনতে পারি না। ধর্ষণের ঘটনায় চুপ করে থাকার কারণে দিন দিন এটা বেড়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাওয়ায় দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তিন মাসের মধ্যে ধর্ষণের বিচার সম্পন্ন করাটা নিশ্চিত করতে হবে।’
আবেদ খান বলেন, ‘ধর্ষণের জন্য কতিপয় ব্যক্তি নয়, গোটা ব্যবস্থাকেই দায়ী করি। এখন মনুষ্যত্ব বলতে কিছু নেই। দেশে মূল্যবোধকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাই একাত্তরকে এখন আর খুঁজে পাই না। রাজনীতিবিদরা ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের স্বার্থে কাজ করছে। তাই সেখানেও কোনো মূল্যবোধ নেই।’
গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ধর্ষণের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বন্ধে প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
শাহবাগে ষষ্ঠ দিনের কর্মসূচি : ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে শাহবাগে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিবাদ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ষষ্ঠ দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। সমাবেশ থেকে ধর্ষণ ও নিপীড়ন বন্ধে গত শুক্রবার ঘোষিত ৯ দফা দাবি বাস্তবায়নের পক্ষে বক্তব্য দেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অণীক রায়। তিনি বলেন, ‘৯ দফা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখা হবে।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিভিন্ন কর্মসূচি : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সকাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এ সময় বক্তারা বলেন, করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, তখন নোয়াখালী, সিলেট, মুন্সীগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনাগুলো আমাদের উন্নয়ন ও সভ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় এই পরিস্থিতির সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই যা পুনঃস্থাপন করা সম্ভব। ধর্ষকের নৃশংসতা বর্বর যুগকেও হার মানিয়েছে। বিচারের পথ যখন দুর্গম হয়, নির্যাতন তখন ব্যাপকতা পায়। বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ, মইনীয়া যুব ফোরাম, জাতীয় মহিলা পার্টি ও জাতীয় যুব সংহতি।
ভাসানী অনুসারী পরিষদ আয়োজিত এক মানববন্ধনে সারা দেশে ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা দ্রুত আমলে নিয়ে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা আপনার মঙ্গল চাই, আপনার সুশাসন চাই।’ ধর্ষণের আসামির ফাঁসিকে ধাপ্পাবাজি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের মতো এত বড় অপরাধ যারা করেছে, তাদের দুই মিনিটের ফাঁসি! ধর্ষণকারীদের ৫০ বছর কারাদণ্ডের দাবি জানাই।’